Blog

কিভাবে ‘নিউ ইয়ার’ পালন শুরু

যে সব উৎসব পৃথিবীব্যাপী পালন করা হয়, তাদের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো উৎসব হলো এই বর্ষবরণ উৎসব  ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’

গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয় মাত্র ৪০০ বছর আগে, ১৫৮২ সালে, গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ১ জানুয়ারির বর্ষবরণ উৎসব
এই যে নিউ ইয়ারে সবাইকে উইশ করবেন, এই নিউ ইয়ার পালন কবে থেকে শুরু হয়েছে, জানেন কি? তাহলে চলেন, আগে জেনে নেই, কিভাবে এই ‘নিউ ইয়ার’ পালন করা শুরু হলো।
 
বলা হয়, যে সব উৎসব পৃথিবীব্যাপী পালন করা হয়, তাদের মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো উৎসব হলো এই বর্ষবরণ উৎসব। কবে শুরু হলো এই উৎসব? এই উৎসব শুরু হয় প্রায় ৪০০০ বছর আগে, খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে। সে সময় মেসোপটেমীয় সভ্যতায় প্রথম বর্ষবরণ উৎসব চালু হয়। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিলো, তাকে বলা হয় মেসোপটেমীয় সভ্যতা। বর্তমানের ইরাককে প্রাচীনকালে বলা হতো মেসোপটেমিয়া। এই মেসোপটেমিয়ান সভ্যতার আবার ৪টা আলাদা আলাদা ভাগ আছে, সুমেরীয় সভ্যতা, ব্যাবিলনিয় সভ্যতা, আসিরিয় সভ্যতা ও ক্যালডিয় সভ্যতা। এদের মধ্যে বর্ষবরণ উৎসব পালন করা শুরু হয় ব্যাবিলনিয় সভ্যতায়। সে সময় বেশ জাঁক জমকের সঙ্গেই পালন করা হতো বর্ষবরণ। তবে সেটা কিন্তু এখনকার মতো জানুয়ারির ১ তারিখে পালন করা হতো না। তখন নিউ ইয়ার পালন করা হতো বসন্তের প্রথম দিনে। বসন্তকাল এলে শীতকালের রুক্ষতা ঝেড়ে প্রকৃতি আবার নতুন করে সাজগোজ করতে শুরু করে, গাছে গাছে নতুন করে পাতা গজাতে থাকে, ফুলের কলিরা ফুটতে শুরু করে, সেইসঙ্গে পাখিরা ডানা ঝাঁপটে শুরু করে দেয় গান। আর প্রকৃতির এই নতুন করে জেগে ওঠাকেই তারা নতুন বছরের শুরু বলে চিহ্নিত করেছিল। অবশ্য তারা তখন চাঁদ দেখে বছর গণনা করতো। তাই উৎসব শুরু হতো চাঁদ দেখে। আমরা যেমন এখন ঈদের চাঁদ দেখি, ওরাও কিন্তু তখন সেভাবেই বর্ষবরণের চাঁদ দেখতো। তারপর যেদিন বসন্তের প্রথম চাঁদ উঠতো, শুরু হতো তাদের বর্ষবরণ উৎসব, চলতো টানা ১১ দিন। এই ১১ দিনের অবশ্য আলাদা আলাদা তাৎপর্যও ছিলো।
 
ব্যাবিলনিয় সভ্যতার পর জাঁকজমক করে নববর্ষ পালন করতো রোমানরাও। ওরা আবার এক কাঠি উপরেই ছিলো। তৈরি করে ফেলেছিলো ক্যালেন্ডার। সে ক্যালেন্ডারও অবশ্য রোমানরা চাঁদ দেখেই বানিয়েছিল। আর সেই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ওদের নববর্ষ ছিলো ১ মার্চ। তবে প্রথম দিকে ওদের ক্যালেন্ডারে মাস ছিল মাত্র ১০টা, ছিল না জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি। পরে সম্রাট নুমা পন্টিলাস জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিকে ক্যালেন্ডারে যোগ করেন। সমস্যা ছিল আরো, রোমানদের ক্যালেন্ডারে তারিখও ছিলো না। চাঁদের বিভিন্ন অবস্থা দিয়ে ওরা মাসের বিভিন্ন সময়কে চিহ্নিত করতো। চাঁদ ওঠার সময়কে বল হতো ক্যালেন্ডস, পুরো চাঁদকে বলতো ইডেস, চাঁদের মাঝামাঝি অবস্থাকে বলতো নুনেস। পরে সম্রাট জুলিয়াস সিজার এই ক্যালেন্ডারের পরিবর্তন ঘটান। তিনি ক্যালেন্ডস, ইডেস, নুনেসের ঝামেলা শেষ করে বসিয়ে দেন তারিখ। ফলে বছরে মোট ৩৫৫ দিন হয়। ভাবছেন, আর ১০ দিন তাহলে গেলো কোথায়? আসলে তারা তো তখন চাঁদকে দিয়ে বছরের হিসেব করতো। আর আমরা এখন বছরের যে হিসাব করি, সেটা তো সূর্য দিয়ে হিসাব। চাঁদের হিসাব করায় তাদের বছরে ১০ দিন কম থেকে গিয়েছিল। জানেন নিশ্চয়ই, চাঁদের হিসাবে প্রতি মাসে দিন হয় সাড়ে ২৯ টি। এজন্যই আরবি হিজরি সালের মাসগুলো ২৯ কিংবা ৩০ দিনে হয়। তো, যেটা বলছিলাম, ঐভাবে বছর হিসাবের ফলে চাষিরা পড়লো সমস্যায়। এই সমস্যার সমাধান করলেন হোঞ্চাস হেডাস নামের এক রোমান। তিনি করলেন কি, ফেব্রুয়ারির পরে আরেকটা অতিরিক্ত মাসই ঢুকিয়ে দিলেন। তখন সিজার দেখলেন, অবস্থা তো বড়ো বেগতিক। পরে অনেক চিন্তা ভাবনা করে দেখলেন, এতো ঝামেলা পাকানোর তো কিছু নেই, চাঁদের হিসাব না করে, সূর্য দিয়ে হিসাব করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। ব্যস, সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো। বছর হয়ে গেলো ৩৬৫ দিনের। তবে অনেকে বলে তিনি সূর্য দেখে প্রথমে ৩৬৫ দিনের নয়, ৪৪৫ দিনের ক্যালেন্ডার বানিয়েছিলেন!
 
তাহলে বুঝতেই পারছেন, রোমান সাম্রাজ্যে এই ক্যালেন্ডার নিয়ে কতো রাজ্যের ঝামেলা হয়েছিলো। আর তাই সে সময় কবে যে নতুন বছর শুরু হবে, সেটা ঠিকই করা যাচ্ছিলো না। একেক সময় একেক জায়গায় একেক দিন নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে পালিত হতো। যিশু খ্রিস্টের জন্মের ৬০০ বছর আগে, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৬০০ অব্দে ঠিক করা হয়েছিলো বর্ষবরণ হিসেবে পালন করা হবে ২৬ মার্চ তারিখটি। কিন্তু সেটা ঠিকভাবে মানাই হচ্ছিলো না। পরে সম্রাট নুমা পন্টিলাস যখন জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারিকে ক্যালেন্ডারে ঢোকান, তিনি ঠিক করে দেন, জানুয়ারির ১ তারিখ হলো বছরের প্রথম দিন। ওইদিনই হবে বর্ষবরণ। কিন্তু সে কথাও মানা হলো না। রোমানরা সেই আগের মতো মার্চের ১ তারিখেই বর্ষবরণ উৎসব করতে লাগলো। পরে জুলিয়াস সিজার যখন ৩৬৫ দিনে বছরের ঘোষণা দেন, তখন আবার বলে দেন, মার্চে নয়, বছর শুরু হবে জানুয়ারির ১ তারিখে। উৎসবও সেইদিনই হবে। এইবার কাজ হলো। বর্ষবরণ উৎসব মার্চ মাস থেকে চলে এলো জানুয়ারিতে।
 
আপনারা তো ভাবছেন, সেই যে রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার শুরু করে গেছেন, আমরা এখনো সেইদিনেই বর্ষবরণ উৎসব করছি! আসলে কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। যদিও আমরা জানুয়ারির ১ তারিখেই উৎসব করছি, দিনটা কিন্তু এক নয়। সিজারের ক্যালেন্ডারেও সমস্যা ছিলো। সেই সমস্যা দূর করেন একজন ডাক্তার। নাম তার অ্যালোসিয়াস লিলিয়াস। কিন্তু ইতিহাসে তার নাম সেভাবে কেউ জানে না। কারণ, ক্যালেন্ডারটির কথা সবাইকে জানান একজন পোপ। সবাই তাকেই চেনে। তিনি পোপ ত্রয়োদশ (১৩তম) গ্রেগরি।  পোপ গ্রেগরির নাম অনুসারে ক্যালেন্ডারটির নামকরণ করা হয়েছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। আমরা এটিই ব্যবহার করি। এই ক্যালেন্ডারটি তৈরি করা হয় মাত্র ৪০০ বছর আগে, ১৫৮২ সালে। আর এটি বের করার পর এর সুবিধার কারণে আস্তে আস্তে সকল জাতিই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা শুরু করে। ফলে আগে যারা নিজস্ব ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বর্ষবরণ উৎসব পালন করতো, তারাও এখন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী জানুয়ারির ১ তারিখেই নববর্ষ হিসেবে পালন করতে শুরু করে দিলো। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়লো ১ জানুয়ারির বর্ষবরণ উৎসব। আর এখন তো পুরো পৃথিবী জুড়েই সবাই নিজস্ব বর্ষবরণের পাশাপাশি পালন করে ইংরেজি নববর্ষ। আমরাও পহেলা বৈশাখের পাশাপাশি প্রতিবছরই ১ জানুয়ারিতেও বর্ষবরণ করি। এদিনও আমরা সারারাত আনন্দ করি, ইউরোপ আমেরিকায় ১ জানুয়ারি সবাই ছুটি কাটায়।
Blog Author

Md Abdul Gaffer

Written by

RECIPE REVIEWS

Login to comment